শিরোনামঃ
![]() ৩০-০৬-২০২১ ০৫:০০ অপরাহ্ন |
মোহন, শামীম, নাইম ও নাইমুর রহমান। আর সব শিক্ষার্থীর মতো এই চার শিক্ষার্থীরও করোনায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তবে প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও ওরা অন্য এক স্বপ্নের পথে ব্যস্ত সময় পার করছেন। ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইন্সস্টিটিউটের ডিপ্লোমা মেকানিক্যাল টেকনোলোজির চূড়ান্ত বর্ষে পড়ছেন মোহন মিয়া ও শামীম রানা। আর ঢাকার তিতুমির কলেজে রসায়ণে অনার্স করছেন তানজিরুল ইসলাম নাইম। করোনায় চার বন্ধু নিজেদের বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার যমুনায় জেগে ওঠা চরগিরিশ ইউনিয়নের গুয়াহখোড়া গ্রামে ফিরে আসেন। এদের একজন মোহন মিয়া একদিন ইউটিউবে খুঁজে পান কলাগাছ থেকে সুতো তৈরির কলাকৌশল। যেই দেখা অমনি চার বন্ধু মনস্থির করে নেমে পড়লেন কাজে। প্রথমে তারা ময়মনসিংহ থেকে চল্লিশ হাজার টাকায় কিনে আনেন ফাইবার এক্সট্রাকশন মেশিন। কয়েকদিন ভালোভাবে রপ্ত করলেন সুতো তৈরির নানা কৌশল। এরই মধ্যে পুরো চরাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে কলাগাছ থেকে সুতো তৈরির কাহিনী। অনেকে দেখতে আসে। এতে করে উৎসাহ বাড়তে থাকে চার বন্ধুর। কিন্তু কাজে সফল হতে হলে আরও কিছু প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। এজন্য আরও টাকার দরকার। চাই একটি ঘর।
তাদের অদম্য সাহস আর সংগ্রামে মুগ্ধ হয়ে ওই গ্রামের ওয়াহাব নামের একজন তাদের পাশে দাঁড়ান। তিনি একটি বড় টিনের ঘর তাদের কাজের জন্যে ছেড়ে দেন। সেই ঘরেই তারা ওই মেশিন স্থাপন করেন । আর মেশিন কেনার সময়ে মিলন নামের একজন তাদের কিছু সহায়তা দেন।
এরপর কলাবাগান থেকে কলার কাদি কাটার পরে ফেলে দেয়া কলাগাছ আনা হয় । লম্বা করে কেটে প্রসেস করা হয় সেগুলি। তারপর মূল মেশিন চালু করে সেখানে কলাগাছের ওই লম্বা অংশ ধরা হয়। অনেকটা ধানের আঁটি থেকে ধান ছাড়ানো মেশিনের মতো করে কলার কান্ড ধরা হয়। ওপাশ দিয়ে সুতা হয়ে তা বের হয়। এই সুতা রোদে শুকালে সোনালী রং ধারণ করে। প্রতিদিন ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ কেজির মতো সুতা উৎপাদন করছেন তারা।
এ বিষয়ে কথা বলেন তরুণ উদ্যোক্তা মোহন মিয়া। তিনি সিরাজগঞ্জকণ্ঠকে জানান,
কলা গাছের কান্ড প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে সুতা। প্রতিদিন আমরা চার বন্ধু দিনরাত এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি জানান, সুতাগুলো বের হবার পর তা রোদে শুকিয়ে নিয়ে ঘরে স্টক করে রাখছি।
আরেক উদ্যোক্তা শামীম রানা জানান, সুতা তৈরির সময়ে উপজাত হিসেবে পাওয়া পানি আমরা সংরক্ষণ করছি। এই পানি বিভিন্ন ডিটারজেন্ট তৈরির কাজে এবং তারপিন তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। এর মন্ড থেকে পরিবেশ বান্ধব পলিথিন ও নিউজ পেপার তৈরির গবেষণাও আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। আর কলাগাছের অবশিষ্টাংশ জৈব সার হিসেবে উৎকৃষ্ট। তাই কলাগাছ থেকে সুতা তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটাই পরিবেশ সম্মত ।
উদ্যোক্তা নাইম জানান, প্রতিদিন আমরা চরের নানা প্রান্ত থেকে ঘো[ড়ার গাড়িযোগে কলাগাছগুলো বিনামূল্যে সংগ্রহ করি। প্রতি গাড়িতে ৩০ থেকে ৩৫টি কলাগাছ নেয়া সম্ভব। গাড়ি প্রতি ভাড়া দিতে হয় দুইশ টাকা। দিনে প্রায় চার থেকে পাচঁটি গাড়িতে করে কলাগাছ আনা হয়। দূর্গম চরাঞ্চল হওয়ায় পরিবহণ ব্যয় বেশ বেশি। নাইম বলেন, কলার কাদি কেটে নেওয়ার পর কলা গাছটি আমরা নিয়ে যাচ্ছি। এতে করে জমির মালিকেরও উপকার হচ্ছে। না হলে লেবার দিয়ে তাদের সরিয়ে ফেলতে হতো।
সুতার তৈরির পূঁজি এবং সুতার বাজার ব্যবস্থা সম্পর্কে মোহন মিয়া বলেন, আমরা চার বন্ধুই নি¤œমধ্যবিত্ত ঘরের শিক্ষার্থী। নিজেদের উদ্যমে কিছু অর্থ জুগিয়ে এ কাজে নেমেছি। মেশিন ও অন্যান্য খরচ মিলে প্রায় এক লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে এরই মধ্যে। এখনও প্রতিদিন গাড়িভাড়া দিতে হচ্ছে। আর এই কাজ নিরবচ্ছিন্নভাবে করতে আমরা চার বন্ধু নিজেদের বাড়ি ছেড়ে এই কারখানাতেই থাকছি। এখানেই নিজেরা রান্না করে খাচ্ছি।
উৎপাদিত সুতা কি করছেন জানতে চাইলে তিনি জানান, এখনো আমরা সুতা বিক্রি করিনি। তবে ময়মনসিংহের এক উদ্যোক্তা আড়াইশ টাকা কেজি দরে এই সুতা বিক্রি করছেন। আবার ঢাকার এক পার্টি আমাদের সাথে যোগাযোগ করে সুতা নেবার আগ্রহ দেখিয়েছে। আর মেইলে বাইরের দুটো দেশের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। তারা বলেছেন বিশ থেকে ত্রিশ টন হলে একবারে তারা নেবে। কিন্তু আমাদের সে সামর্থ্য এই মুহূর্তে নেই।
পরিবেশ বান্ধব এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে সরকারী সহায়তা দরকার জানিয়ে উদ্যোক্তারা জানান, এ পর্যন্ত প্রায় ১৫০ কেজি সুতা তারা উৎপাদন করেছেন। এখন সেগুলো রাখারই কোন জায়গা নেই। নেই কর্মের উপযুক্ত আবাসন, উন্নত প্রশিক্ষণ কিংবা অর্থ।
চরগিরিশ ইউনিয়ন আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্কুল শিক্ষক আব্দুল মালেক বিএসসি জানান, ‘ছেলেদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। নিজে দেখেছি আমি ওদের কাজ। সরকারি সহায়তা ও উন্নত প্রশিক্ষণ পেলে ওরা আরও ভালো করবে।’
এ কাজিপুর উপজেলা কৃষি অফিসার রেজাউল করিম জানান, ‘ খবরটি নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। কলাগাছের অবশিষ্টাংশ উৎকৃষ্ট জৈব সার। এটাও সংগ্রহ করে বিক্রি করা সম্ভব। উদ্যোক্তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ। এ বিষয়ে সরকারি প্রণোদনার জন্যে চেষ্টা করবো।’
কাজিপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহিদ হাসান সিদ্দিকী জানান, ‘ উনাদের বিষয়ে আপনার মাধ্যমে জানলাম। আমরা খোঁজ নেবো। যদি সম্ভাবনার দিকটি ভালো হয় তাহলে কর্মসংস্থান ব্যাংক আছে উনারা সেখান থেকে অর্থ নিতে পারবেন। এছাড়া সরকারি নানা সহায়তা দিকটিও আমরা বিবেচনা করবো। ’
সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে চার যুবকের এই স্বপ্ন আলোয় উদ্ভাসিত হবে। সৃষ্টি হবে অনেক বেকারের কর্মসংস্থান।
ঠিকানা : অনামিকা কনকর্ড টাওয়ার, বেগম রোকেয়া স্মরনী, তৃতীয় তলা, শেওড়াপাড়া, মিরপুর, ঢাকা- ১২১৬
মোবাইল : ০১৭৭৯-১১৭৭৪৪
ইমেল : info@sirajganjkantho.com