ভূগর্ভের স্তরে মিশ্রিত হচ্ছে কেমিক্যালের বর্জ্য, সুপেয় পানির সংকটে স্থানীয়রা
সিরাজগঞ্জের বেলকুচি তাঁত শিল্প সমৃদ্ধ উপজেলাতে স্থানীয় তাঁত শিল্পের কাঁচামাল সুতা, রংসহ বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্য মিশ্রিত দূষিত পানি প্রতিনিয়ত ফেলা হচ্ছে ছোট ছোট খাল বিল ও যমুনা নদীতে। এ পানি আবার যাচ্ছে নলকুপ গুলোতে। অনেক স্থানেই স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিদ্যুৎ চালিত পাম্পের সাহায্যে এসব কেমিক্যালের বর্জ্য মিশ্রিত পানি মাটির নিচে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরেও মিশিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। ফলে নলকুপের পানিতে সাবানের মত ফেনা ও রঙিন পানি বের হচ্ছে। যা ব্যবহার ও খাওয়ার অনুপোযোগী তথাপি বাধ্য হয়ে তা খাচ্ছে মানুষ। একটু বাতাসেই দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে বেলকুচির বিস্তৃত এলাকা। তাই এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সরকারের সহায়তা চাইলেন উপজেলাবাসী।
বেলকুচি উপজেলা প্রসেস মিল মালিক সমিতি সূত্রে জানাযায়, শুধুমাত্র বেলকুচি পৌরসভাতেই সূতা প্রসেস মিল রয়েছে সমিতি ভুক্ত ১৬ টি। এর বাহিরে ফিরোজা রঙের মিল, তাঁতীদের প্রায় সব বাড়িতে সূতা রঙের ডাইং কারখানা বিচ্ছিন্ন ভাবে কেমিক্যাল ব্যবহৃত ছোট বড় কারখানা রয়েছে।
এছাড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৩০ থেকে ৪০ টির মত রয়েছে সূতা প্রক্রিয়াজাত করণ প্রতিষ্ঠান। প্রায় পাঁচশত রয়েছে ডাইং ও ২৫টির মত রয়েছে ফিরুজা রঙের মিল ।
সরেজমিনে বৃহস্পতিবার (১৫ এপ্রিল) গিয়ে দেখা যায়, বেলকুচির তামাই গ্রামের নতুন পাড়া প্রায় লোক নলকুপের পানি পান করতে পারছে না। পাইপের সাহায্যে দুর থেকে পানি বয়ে পান করতে হয়। যারা একটু স্বচ্ছল তারা বোতল জাত পানি ক্রয়করে পান করছেন। এলাকাটির ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে বর্জ্য মিশ্রিত দূষিত পানি ছড়িয়ে পড়ায় অনেক দুরের পানিও খাবারের অযোগ্য বলে জানালেন স্থানীয়রা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ইলেকট্রিশিয়ান জানায়, তামাই গ্রামের মুন্সী ব্রাদার্স প্রসেস কারখানার কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্য পানি এখন গোপনে ঘরের মধ্যে বিদ্যুৎ চালিত পাম্প বসিয়ে মাটির নিচে দেয়া হচ্ছে । তিনি প্রসেস কারখানটিতে বিদ্যুতের কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন।
নাম প্রকাশ করতে ওনার কোন সমস্যা নেই, তবে কারখানা মালিকগণ প্রভাবশালী এ কারনেই তার এমন আপত্তি। এমন অনেক কারখানা থেকেই মাটির নিচে বর্জ্য মিশ্রিত পানি দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
তামাই গ্রামের অনেকেই জানান, কতটা দিন হলো আমার একটু শান্তিতে পানি পান করতে পারিনা। নলকুপের পানিতে ফেনা ওঠে। পানি খাওয়া তো দুরের কথা গোসল করলেও সমস্যা। একটু বৃষ্টি হলে প্রসেস কারখানার পানির দুর্গন্ধে থাকা মুসকিল। কারখানা মালিকদের বলে কোন লাভ হয় না।
মোহাম্মদ আলী বলেন, আমরা বারবার সমস্যার কথা জানালে কারখানা মালিকরা কিছু স্থানে পাইপের সাহায্যে পানি বহন করে নিয়ে এসে সরবরাহ করছে। কিন্তু সে পানিও পান করবার অনুপযোগী। পানি কিছুক্ষণ পাত্রে রাখলে নিচে ধাতপ পদার্থের মত কি যেন জমাট বাঁধে।
অনেক আক্ষেপ করে একই গ্রামের বাবুল খাঁন জানান, আপনাদের কাছে দুঃখের কথা বলে কি লাভ? কারখানা মালিকদের অনেক টাকা তারা টাকা দিয়ে সবার মুখ বন্ধ রাখে। আমরা যে কী কষ্টে আছি তা বলে বুঝাতে পারবো না। মুন্সী ব্রাদার্স প্রসেস কারখানার বর্জ্য মিশ্রিত পানি এখন মাটির নিচে দেওয়া হচ্ছে। যে কারনে অনেক দুর থেকে টেনে আনা নলকুপের পানি খেয়ে শিশুরা মাঝে মধ্যেই অসুস্থ হচ্ছে।
তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ুয়া ছোট শিশু আয়শা খাতুন বলে,আমারা এ পানি খাইতে পারিনা, একটু খেলে পেট ব্যথা করে। এ এলাকায় নলকুপ গুলো চেপে দেখা যায় পানিতে এক প্রকার ফেনার সৃষ্টি হচ্ছে।
এই পানি খাবারের জন্য তো দুরের কথা গোসলেরও অযোগ্য বলে দাবি করছেন তামাই আল অমিন তাঁত কার খানায় কর্মরত কুড়িগ্রাম থেকে আসা শ্রমিক ইউসুফ আলী। তিনি তার শরীর দেখিয়ে বলেন দুই দিন এই পানিতে গোসল করে শরীরে ছোট ছোট গোটার মত কী যেন উঠেছে। অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করছে।
দীর্ঘদিনের সমস্যাটি সমাধানে সরকারের সহায়তা চাইলেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও। সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক জহুরুল হক জানান, সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে এই শিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের তাঁত শিল্প একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে এখনই সময় এসেছে পরিকল্পা করবার। এক্ষেত্রে গুরুত্ব সহকারে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে এগিয়ে আসতে হবে ।
মুন্সী ব্রাদার্স প্রসেস কারখানার স্বত্বাধিকারী শওকত মুন্সি জানান, আমরা বর্জ্য মাটির নিচে দেই না। নিজস্ব খালের মধ্যে ফেলি। আসলে এভাবেও বর্জ্য ফেলতে চাই না। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের পক্ষ হতে উদ্যোগ নেওয়া হলে আমরাও সহায়তা করবো।
বেলকুচি প্রসেসমিল মালিক সমিতির সভাপতি হাজী আব্দুল মজিদ জানান, সব প্রসেস কারখানাকে একত্রিত করে একই অঞ্চলে নিয়ে একটি ইটিপি প্লান্ট তৈরীর প্রস্তাবনা আমরা জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে সরকারকে দিয়েছি। বাস্তবায়ন হলে এই সমস্যার সমাধান হবে।