বাংলা কবিতার ইতিবৃত্ত- রচনার কৌশল- সাইফুল্লাহ মামুন
১৮ মে, ২০২৪ ০৮:৫৮ অপরাহ্ন

  

বাংলা কবিতার ইতিবৃত্ত- রচনার কৌশল- সাইফুল্লাহ মামুন

আব্দুল জলিল
০৩-০৫-২০২৪ ০৫:৩১ অপরাহ্ন
বাংলা কবিতার ইতিবৃত্ত- রচনার কৌশল- সাইফুল্লাহ মামুন

  ।
শস্যক্ষেত্র উর্বর হ'ল, পুরুষ চালাল হল,
নারী সেই মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর নারী কবিতার দুটি চরণ নিয়ে বলছি।
প্রথম চরণের শেষে হাল (লাঙ্গল বা হাল) শব্দটির পরিবর্তে হল লিখেছেন শুধুমাত্র শেষের চরণের সুশ্যামল এর সাথে ছান্দিক মিলের জন্যই।বারবার, বারংবার -বিশ্বের সকল সাহিত্যে আপনি এরকম কাব্যিক আশ্রয় দেখতে পাবেন।তাই অতিরিক্ত উদাহরণ দিতে চাচ্ছি না।কথাগুলো এজন্য বলে নিচ্ছি যে আমি নিজস্ব ধারায় সনেট লিখি- মাত্রা, পর্ব,ছন্দ ইত্যাদি বিষয়ের যথার্থতা এতটা লক্ষ রেখে লিখি না।
এ.গ.ঐড়ঢ়শরহং ও নিজের মতো করে লিখেছেন সনেট। নামকরণ করা হয়েছে ঈঁৎঃধষ ংড়হহবঃ.যেমন চরবফ ইবধঁঃু,চবধপব ,চবধপব পড়লে বুঝবেন। তাহলে আমি আমার মতো করে লিখলে অসুবিধা কোথায়? তার আলাদা বিশেষণ না হয় সমালোচকরাই দিবেন।প্রথম যিনি সনেট লিখেছেন তিনি কিন্তু নিজেই তা আবিষ্কার করেছেন।ঈশ্বর তাকে নিয়ম শেখান নি।নিয়ম নিজেই সৃষ্টি করেছেন। বাস্তবতা বুঝতে হবে। সেই নিরিখে আপনিও আবিষ্কার করতে পারেন, সংযোজন-বিয়োজন করে নিজের মতো করে নিতেই পারেন।এজন্য অনেকেই বলেন - কবি যা বলে তাই সঠিক।
এখন আসি কবিতা কখন কবিতা হয়-
মূলত মানুষের মন যা পড়ে নিজের অজান্তেই তাকে কবিতায় আখ্যায়িত করে তখনি তা কবিতা হতে পারে। সে ভাললাগা কখনো বুঝানো সম্ভব না। (আমার মতামত)
তবে একথা বলতেই হবে সুন্দর, অস্বাভাবিক শব্দচয়ন, ছন্দের মাধ্যমে সত্য ফুটিয়ে তুলতে পারলে মানুষের মন তাকে ভালবেসে ফেলে।
আর একারণেই মনে হয় ঈশ্বর স্বয়ং ওসব পছন্দ করেন।
চলুন দেখে আসি ---
*ন তেন অরিযো হোতি যেন পাণানি হিংসতি,
অহিংসা সব্বপাণানং অরিযো'তি পবোচ্চতি*
-হিংসতি
-পবোচ্চতি।
(সুন্দর ছন্দ)
অর্থ-
যে ব্যাক্তি প্রাণী হত্যা করে তা দ্বারা সে আর্য হতে পারে না।
যিনি সকল প্রাণীর প্রতি অহিংসা পোষণ করে তাকেই আর্য বলে।
(ধম্মপদ,ত্রিপিটক)
-
কি সুন্দর!ছন্দময়!অর্থও সুন্দর, তাই না?
শ্রীমদভগবদগীতাও সম্পূর্ণ ছন্দে ছন্দে যায়।কিছুটা ব্যাতিক্রম ছাড়া তা অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত। আসুন একটু পড়ি-
বীজং মাং সর্বভূতানাং বিদ্ধি পার্থ সনাতনম্।
বুদ্ধির্বুদ্ধিমতামস্মি তেজস্তেজস্বিনামহম্
-সনাতনম্,
-স্বিনামহম্।
(সুন্দর ছন্দ)

অর্থ-
হে পার্থ, আমাকে সর্বভূতের সনাতন কারণ বলে জানবে,
আমি বুদ্ধিমানের বুদ্ধি এবং তেজস্বীদের তেজ।
শ্রীমদভগবদগীতা, সপ্তম অধ্যায়, শ্লোক-১০।
ছন্দময়, সুন্দর কথা।
এবার পবিত্র কোরআন নিয়ে পড়ি-

ইন্না আ'তাইনা কাল কাওছার,
ফাছাল্লি লিরাব্বিকা ওয়ানহার।
-কাওছার,
-ওয়ানহার।
অথবা-
-ছার,
-হার।
(সুন্দর ছন্দ!!!)
অর্থ-নিশ্চয়ই আমি তোমাকে হাউজে কাওসার দান করেছি,
অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় করো এবং কুরবানী করো।
সুরা কাওসার, আল কোরআন।
কতইনা সত্য ছন্দময় সুন্দর কথা!!!

বস্তুত সম্পূর্ণ কোরআনের ছন্দ নিয়ে বলতে গেলে আমাকে হয়তো একচোখা বা কট্টরপন্থী মুসলিম ভাবলেও আমি রাগ করবো না।কারণ সুরা ফাতিহা পড়েন, সুরা নাস পড়েন বা আপনার যা ইচ্ছা পড়েন-আপনি অবাক হবেন-এতটা সুন্দর ছন্দের লহরী কোথাও নেই।

সূরা মাঊন-
১.আরাআইতাল্লাযী ইউকাযযি বুবিদ্দীন।
২.ফাযা-লিকাল্লাযী ইয়াদু‘‘উল ইয়াতীম।
৩.ওয়ালা-ইয়াহুদ্দু‘আলা-তা‘আ-মিল মিছকীন। ৪.ফাওয়াইঁলুলিলল মুসাল্লীন।
৫.আল্লাযীনাহুম ‘আন সালা-তিহিমি ছা-হূন।
৬.আল্লাযীনা হুম ইউরাঊনা
৭.ওয়া ইয়ামনা‘ঊনাল মা-‘ঊন।

(বাহ!বাহ!অসাধারণ বলতেই হবে)
এবার দেখি অর্থটা সুন্দর কিনা!!!
 ১.আপনি কি দেখেছেন তাকে, যে বিচারদিবসকে মিথ্যা বলে?
২.সে সেই ব্যক্তি, যে এতীমকে গলা ধাক্কা দেয়
৩.এবং মিসকীনকে অন্ন দিতে উৎসাহিত করে না।
৪.অতএব দুর্ভোগ সেসব নামাযীর।
৫. যারা তাদের নামায সম্বন্ধে বে-খবর।
৬.যারা তা লোক-দেখানোর জন্য করে।
৭.এবং নিত্য ব্যাবহার্য্য বস্তু অন্যকে দেয় না।

কি? সুন্দর না?
তাহলে দেখা যাচ্ছে সত্য যদি ছন্দের সাথে মিশ্রিত হয় তা অমৃত।
তবে বলে নিচ্ছি ধর্মগ্রন্থ বা ঐশ্বরিক বাণীর ছন্দ, মাত্রা, পর্ব ইত্যাদি সম্পর্কে গবেষণা করা যায়। তাকে অনুকরণও করা যায়।তবে তার সাথে তুলনায় যাওয়া যায় না।কারণ তা স্বর্গীয় এবং অসীম।

এবার আসুন দেখি স্বাভাবিক ছন্দ ছাড়াও ছন্দ হয়- সেটাও কবিতা, যদি মনে সাঁয় দেয় যে তা সত্য এবং সুন্দর, ভাললাগার বিষয়।
"আমি স্বাধীনতা পেয়ে গেলে পরাধীন হতে ভালোবাসি।
প্রেম এসে যাযাবর কন্ঠে চুমু খেলে মনে হয় বিরহের
স্মৃতিচারণের মতো সুখ কিছুই নেই।
(অসমাপ্ত কবিতা, কবি নির্মলেন্দু গুণ।)
আমার কাছে খুব প্রিয় দুটি চরণ। বিখ্যাতও বটে।
এটুকুতে ছন্দ মিল খুঁজতে গেলেই এটুকুর রস হারাবেন।
অর্থাৎ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে বলতে চাই,কবিতা ফুলের মতো, গন্ধ শুকে ভাল লাগলেই কবিতা। আবেগে, ভালবাসায় নিয়ম কিসের?
কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর কবিতার সংজ্ঞাটি আমার অনেক ভাল লাগে যেখানে তিনি বলেছেন-
"কবিতা হলো শক্তিশালী অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ "
তাহলে তো জোর দিয়েই বলবো যে, শক্তিশালী অনুভূতির স্বত:স্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশে যদি নিয়ম বা সীমাবদ্ধতা নিয়ে আসেন তাহলে কবিতা তার রূপরস হারাতে বাধ্য।

শব্দচয়ন, যতি চিহ্নের ব্যাবহারও কবিতা সুন্দর করার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।স্বাভাবিক কথাও কবিতার শিল্পে রূপান্তর করা যায় বটে।

"সময় এসে সবই পরিবর্তন করে দিলো।গরমে খরায় ছাতক পাখি উপরের দিকে চেয়ে থাকে।মেঘও হয় না,বৃষ্টিও হয় না।পিপাসায় কাতর সে। বন(বৃষ্টির দূত)তুমি কোথায়?কোথায় খুঁজবো তোমাকে? "
উপরের অংশ যদি নিচের অংশ হয়-
কবিতার শিল্পে রূপান্তর করা যায় বটে।

(সুন্দর শব্দ চয়ন, শব্দের সঠিক স্থান নির্ধারণে কৌশল অবলম্বন করলে যেমনটি হতে পারে -)
কাল এসে হায় করিল সবই পর
তপ্ত খরায় ছাতক চেয়ে ঊর্ধ্বপানে,
মেঘ নাহি গড়ে জল, পিপাসা কাতর
কোথায় অরণ্য তুমি? খুঁজি কোনখানে?

(আমার অরণ্য কবিতা থেকে নিয়েছি)
উপরের অংশটুকু পড়লে মনে হয় এটুকু কবিতা,এতে শৈল্পিক কিছু একটা আছে।
এখন আসবো আবৃত্তির বিষয়টা নিয়ে।
কবিতা যে কবিতা তা অনেকটাই ফুটে উঠে নিখুঁত, দক্ষ, সাবলীল আবৃত্তির উপর। অনেক সময় কবিতা আর কবিতা থাকে না যদি তা আবৃত্তি সঠিকভাবে না করা যায়।
নিচের অংশটুকু পড়ুন -
ইতিহাস! কিসের ইতিহাস? মানি না-
প্রোথিত প্রাণে জেগেছিল নতুন আত্মা,
অতৃপ্ত প্রাণে রচিবে নতুন পৃথিবী,
বিশাল সে মহারণ, সেতো কম নয়!
তপ্ত ময়দানে হানিয়াছ কোটি প্রাণ,
বিজয় বেশে লভিছ কাঙ্খিত উদর,
ছেড়েছ প্রকোষ্ঠ পৃথিবী দেখিবে বলে,
মাতার কলিজায় ঘা- সেতো কম নয়!
আহা!কি যে সুন্দর অবয়ব তোমার।
দেখিছ কি দু চক্ষু মিলিয়া আপনারে?
তুমিই মহা বিস্ফোরণ, নব্য সৃজন,
সংগ্রামী বীর-বিক্রম এ বিশ্ব ভ্রহ্মান্ডে।
কর্ম সাধনার সময়ই ইতিহাস,
তুমিই তো ইতিহাস-এ পৃথিবী পরে।
এই লিখাটুকু সুন্দর-সাবলীল কবিতা হবে কিনা তা অনেকটাই নির্ভর করে আবৃত্তির উপর।
যাহোক, উপরে কবিতা এবং ছন্দ বিষয়ের আলোচনা কারও ভালো না লাগলে বা ভুল হলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
কবি জন কীটস এর মৃত্যুর জন্য কবি শেলী সমালোচকদের সমালোচনাকে দায়ী করেছিলেন।এভাবে সমালোচকদের কারণে সাহিত্যে বিরক্তি আসলেও সাহিত্য সুন্দর হওয়ার জন্য সমালোচনা জরুরী হতে পারে। সমালোচকরা বলে দেন- ত্রুটি- বিচ্চুতির কথা। কিন্তু তাদেরকে ভ্রুক্ষেপ না করে, কটাক্ষ না করে, উৎসাহ ব্যঞ্জক পন্থা অবলম্বন করা জরুরী।
এমতাবস্থায় নানা মুনির নানা মত।কিন্তু আমার মত হলো এই- আমি শুধরাবো না।আমি ছন্দকে ভীষণভাবে ভালবাসি।তবে ছন্দের নিয়ম শব্দটি আমার কাছে বেমানান লাগে।আর মাত্রা, পর্বকে নিজের মতো করে দেখি।এসব নিয়ে কড়াকড়ি কিছু আমার একদমই অপছন্দ। ভাষার অলংকার ভাষাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করলে, স্বাভাবিক গতিকে বাধাগ্রস্ত করলে আমি তার বিরুদ্ধে বলব।আমার শুধু এতটুকু প্রয়োজন যাতে সাধারণ মানুষ আমার কবিতাকে কবিতা বলে স্বীকার করে,যাতে আনন্দ পায়,সত্য উপলব্ধি করে। কোন উচ্চ শিক্ষিত, বরেণ্য সাহিত্যিক তা স্বীকার না করলেও ক্ষতি নেই।
আরও বলতে চাই-মাত্রা, পর্ব, অন্ত্যমিল ইত্যাদি সহ সকল নিয়ম সাহিত্যে জরুরী। ক্ষেত্রবিশেষে তা অনেকের কাছে অপরিহার্য, কবিতার জন্যই দরকারী। কবিতার নিয়ম আমিও মেনে চলি, কিন্তু নিজের ইচ্ছাকে বিকিয়ে দিয়ে নয়।মানে নিয়ম বলেই যে আমি মেনে নিবো তা কখনো হবার নয়।নতুন সৃষ্টি, নতুন উদ্ভাবন সাহিত্যকে আরও উচ্চে সমাসীন করতে পারে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। নিয়ম তো আমরাই আবিষ্কার করেছি বা অনুকরণ করেছি।এটা অপরিবর্তনীয় হতে পারে না। পরিবর্তনই সংসারের নিয়ম।
কথায় আছে ঘড়ঃযরহম রং পড়হংঃধহঃ বীপবঢ়ঃ 'ঈযধহমব'.
কবিতাকে সুন্দর, ছন্দময়, গতিশীল করার জন্য তাকে নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে সম্পূর্ণ আটকানো ঠিক না বলে মনে করি। এটা আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার আর আমি এখানে আমার নিজস্ব মত প্রকাশ করলাম।আরও আবেগ, আরও কথা রয়েই গেলো-আমি নিজের মতো করে গাইতেই থাকবো।আমার গান হয়তো একদিন কোন বিখ্যাত বাংলা সাহিত্যিক মন দিয়ে শুনে আনন্দ নিবেন এবং কবিতার জগতে এভাবেই খুলে যাবে নতুন দ্বার। লেখক: সাইফুল্লাহ মামুন, প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, সখিপুর আবাসিক মহিলা কলেজ, সখিপুর, টাংগাইল।

কবিতার ইতিবৃত্ত- রচনার কৌশল- সাইফুল্লাহ মামুন


আব্দুল জলিল ০৩-০৫-২০২৪ ০৫:৩১ অপরাহ্ন প্রকাশিত হয়েছে
এবং 115 বার দেখা হয়েছে।

পাঠকের ফেসবুক মন্তব্যঃ
Loading...
  • সর্বাধিক পঠিত
  • সর্বশেষ প্রকাশিত

  

  ঠিকানা :   অনামিকা কনকর্ড টাওয়ার, বেগম রোকেয়া স্মরনী, তৃতীয় তলা, শেওড়াপাড়া, মিরপুর, ঢাকা- ১২১৬
  মোবাইল :   ০১৭৭৯-১১৭৭৪৪
  ইমেল :   info@sirajganjkantho.com